Dr Rajendra Prasad ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ: ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতির জীবনী ও অবদান

 ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ: ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও গণতন্ত্রের রূপকার

ভূমিকা

ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সমাজসেবী ছিলেন। ভারতীয় সংবিধান রচনার সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৫০ সালে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সততা, সরলতা ও দেশপ্রেম তাকে ইতিহাসে অনন্য মর্যাদা এনে দিয়েছে। তার জীবন ছিল সাধারণ জীবনযাত্রা, সততা, ও জনগণের সেবার প্রতি নিবেদিত। ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করতে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।



এই নিবন্ধে আমরা তার ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক দর্শন এবং ভারতের জন্য তার অবদান নিয়ে বিশদ আলোচনা করব।


প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

জন্ম ও পরিবার

জন্ম: ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৪, জেরাদাই, বিহার (তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত)।

পিতা: মহাদেব সাহাই, মাতা: কমলেশ্বরী দেবী।

ছোটবেলা থেকেই ধর্মপরায়ণ পরিবারে শৃঙ্খলা ও শিক্ষার পরিবেশে বেড়ে ওঠেন।

শিক্ষাজীবন

ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।

১৮৯৬ সালে পড়াশোনার জন্য চাপড়া জেলার ট্রিকুট স্কুলে ভর্তি হন।

পরবর্তী সময়ে পাটনা কলেজে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন।

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৫ সালে গোল্ড মেডেলসহ আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

পরবর্তীতে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং একজন বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

পেশাগত জীবন

একজন সফল আইনজীবী হিসেবে কলকাতা ও পাটনায় চর্চা শুরু করেন।

১৯১১ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা



চম্পারণ সত্যাগ্রহ (১৯১৭)

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে চম্পারণ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ব্রিটিশ নীলচাষিদের বিরুদ্ধে কৃষকদের অধিকার রক্ষা করতে নেতৃত্ব দেন।

অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২)

সরকারি চাকরি ও আইন পেশা ত্যাগ করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেন।

স্বদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ব্রিটিশ শিক্ষার বিরুদ্ধে বিকল্প ব্যবস্থা চালু করেন।

লবণ সত্যাগ্রহ ও সিভিল অসহযোগ আন্দোলন (১৯৩০)

গান্ধীজির দান্ডি অভিযানকে সমর্থন করে বিহারে আন্দোলন সংগঠিত করেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে ব্রিটিশ সরকার তাকে একাধিকবার কারাবন্দি করে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)

"ভারত ছাড়ো" আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং প্রায় তিন বছর কারাবন্দি থাকেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের রাজনীতিতে ভূমিকা



সংবিধান সভার সভাপতি (১৯৪৬-১৯৫০)

ভারতীয় সংবিধান রচনার সময় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ড. বি. আর. আম্বেদকর, জওহরলাল নেহেরু, ও সরদার প্যাটেলের সাথে মিলে ভারতের সংবিধানের কাঠামো নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

জাতীয় ঐক্য, সাম্য, ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ করেন।

ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি (১৯৫০-১৯৬২)

রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব গ্রহণ

২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।

১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালে পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, যা তাকে ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রপতি করে তুলেছে যিনি পরপর দুইবার এই দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করেন।

টানা ১২ বছর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন, যা ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম।


রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবদান

ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করার জন্য তার অবদান অনস্বীকার্য।

তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক ও কৃষি উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।

রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতেন না।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মজবুত করা

বিচার বিভাগ, সংসদ ও প্রশাসনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেন।

জাতীয় সংহতি বজায় রাখতে কাজ করেন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করেন।

বিদেশ নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

শান্তির পক্ষে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

ভারতকে একটি নিরপেক্ষ ও আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেন।

চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক

জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে মতপার্থক্য

নেহেরুর সাথে ধর্মীয় সংস্কার ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে মতানৈক্য ছিল।

নেহেরু সমাজতন্ত্র ও আধুনিকীকরণের পক্ষে ছিলেন, আর প্রসাদ গান্ধীবাদী ঐতিহ্যের পক্ষে ছিলেন।

যদিও মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু দুজনেই দেশের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করেছেন।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত হওয়া

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন আরো বেশি প্রশাসনিক ক্ষমতা।

কিন্তু ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে মূলত সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।


ব্যক্তিগত জীবন ও মূল্যবোধ

সততা ও সরলতা ছিল তার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়েও তিনি সরকারি সুবিধা কম গ্রহণ করতেন এবং সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন।

তিনি সাহিত্য ও সমাজসেবায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

১৯৬২ সালে ভারত সরকার তাকে "ভারতরত্ন" উপাধিতে ভূষিত করে।

ভারতের গণতন্ত্র গঠনে তার অনন্য অবদানের জন্য তাকে সর্বস্তরের মানুষ সম্মান জানায়।


পরবর্তী জীবন ও মৃত্যু

১৯৬২ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেন।

সমাজসেবা, শিক্ষা ও লেখালেখির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

তার আত্মজীবনী "আত্মকথা" ও "বাপু কে কদমে" অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩ সালে পাটনায় প্রয়াত হন।

১৯৬২ সালে তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান "ভারত রত্ন" প্রদান করা হয়।

ঐতিহ্য ও প্রভাব

১. সংবিধানের স্থপতি

ভারতের সংবিধান প্রণয়নে বিশাল অবদান রাখেন।

ন্যায়, সাম্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন।

২. সততা ও নৈতিকতা

ভারতের অন্যতম সৎ ও নৈতিক রাজনীতিবিদদের একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি থাকা সত্ত্বেও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি।

৩. শিক্ষা ও গ্রামোন্নয়ন

গ্রামোন্নয়ন ও কৃষি উন্নয়নে প্রচুর কাজ করেছেন।

শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।

৪. তার নামে স্মারক ও প্রতিষ্ঠান

রাজেন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহালয় (পাটনা মিউজিয়াম) – তার জীবন ও কাজের ওপর নির্মিত।

ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ রোড (দিল্লি) – তার সম্মানে নামকরণ করা হয়েছে।

Inspiring Quotes by Dr. Rajendra Prasad
ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তি


১. দায়িত্ব ও নেতৃত্ব সম্পর্কে

"আমাদের আদর্শ অর্জনের পথে, আমাদের উপায়ও হতে হবে ততটাই পবিত্র, যতটা আমাদের লক্ষ্য।"


২. জাতীয়তাবাদ ও সেবার বিষয়ে

"আমাদের জনগণের মুক্তি নির্ভর করে ঐক্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মশুদ্ধির ওপর।"


৩. ভারতের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সম্পর্কে

"যদি একটি গণতান্ত্রিক সরকার বারবার জনগণের সমস্যা উপেক্ষা করে, তবে জনগণের গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে।"


৪. শিক্ষা ও জ্ঞানের গুরুত্ব

"একজন প্রকৃত জ্ঞানী নিজেকে কখনও সর্বজ্ঞানী মনে করেন না। তিনি যত জানেন, ততই বুঝতে পারেন যে জানার আরও অনেক কিছু বাকি আছে।"


৫. স্বাধীনতা ও সংগ্রাম সম্পর্কে

"প্রশ্ন করার ক্ষমতা মানুষের অগ্রগতির মূল ভিত্তি।"


৬. দেশপ্রেম ও কর্তব্যবোধ

"আমাদের এমনভাবে বাঁচতে ও কাজ করতে হবে, যাতে আমাদের কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি শক্তিশালী ও উন্নত দেশ গঠনে অনুপ্রাণিত করে।"


৭. নৈতিকতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে

"সফলতা তাদের কাছেই আসে, যাদের আত্মশক্তি ব্যক্তিগত বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে।"

ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ তার সরলতা, প্রজ্ঞা এবং দেশসেবার মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল স্থান অধিকার করেছেন। তার এই উক্তিগুলি আজও লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

উপসংহার

 

ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ছিলেন একজন মহান নেতা, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক এবং ভারতের গণতন্ত্রের অন্যতম স্থপতি।

তিনি তার সততা, নিষ্ঠা ও ত্যাগের মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতিতে এক অনন্য স্থান তৈরি করেছেন।

তার জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে সততা, নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায়।

ভারতীয় সংবিধানের রচনার ক্ষেত্রে তার অবদান অমূল্য এবং তার আদর্শ আজও কোটি কোটি ভারতীয়কে অনুপ্রাণিত করে।

তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, গণতন্ত্র কেবল একটি শাসন ব্যবস্থা নয়, এটি একটি আদর্শ, যা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে। তার অবদান চিরকাল ভারতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

Comments

Contact Form

Name

Email *

Message *

Popular posts from this blog

Nandini Agarwal: Youngest CA in India | Success Story & Achievements 2025

The Pulwama Attack: A Dark Day in India's History

Shefali Jariwala – The Kaanta Laga Girl: From Viral Fame to Tragic Farewell